উদ্ধত বনস্পতির পাতার জাল ভেদ করে সূর্য কিরণের পৃথিবীর বুকের আদিমতা স্পর্শ করা যেখানে প্রায় দুঃসাধ্য সেই গহীন অরণ্য পথে ধীর পায়ে এগিয়ে চলে এক নারী। চারিধারের বনজ গুল্ম আর লোটার মাঝে তাকে প্রকৃতির অংশ বলেই মনে হবে। দেহেজুড়ে বালার্কের লাবণ্য, চোখের তারায় বিদ্যুতের তরঙ্গ নিয়ে ওষ্ঠ যুগলে ব্রহ্মান্ডের রহস্যময় হাসি যা অদৃশ্য দেবতাদের আরাধ্য। মনের আনন্দে পালিত ব্যাঘ্র শাবকটি পিছু নেয় তার।
বনের ঘনত্ব শেষ হয়ে আকাশ যেখানে উদার সেখানে আশ্রমের প্রান্তদেশ। প্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে এক বিরাট যজ্ঞকুণ্ড, এক পাশে জড়ো করা যজ্ঞ সমীধ, ঘিয়ের ভাণ্ড- দেবতার উৎসর্গ করার হব্যি। পর্ণ কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন এক জ্যোতির্ময় ঋষি, তাকালেন দূরের পথে যে পথ দিয়ে তাঁর আদরিনী কন্যা বাক্ তার ব্যাঘ্র শাবকটিকে নিয়ে ফিরছে, যার আলোক বর্তিকা সূর্যের আলোকেও ম্লান করে দেয়। বাক্ এসে দাঁড়ান পিতার সম্মুখে, ঋষির চোখ আদ্র হয়ে ওঠে পিতৃ স্নেহে।
ঋষি বসেন যজ্ঞে, বাক্ আসন নেন পিতার পাশে, সুগভীর দৃষ্টি নিবদ্ধিত যজ্ঞের হোমানলে।যজ্ঞ শেষে পিতা অনুভব করেন এক আশ্চর্য জ্যোতিপুঞ্জ ঘিরে আছে তাঁর কন্যাকে! কে এই কন্যা? ঋষি কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, "বাক্, কন্যা আমার, তুমি কে?" দেবর্ষি আত্মজা বসুন্ধরার কন্যার ধ্বনিত হয়, "আমি একাদশ রুদ্র, অষ্ট বসু, দ্বাদশ আদিত্য এবং বিশ্ব দেবতা। আমি অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্র, মিত্র , বরুণকে ধারণ করি। আমি জগৎ ঈশ্বরী ব্রহ্মস্বরূপিনী। আমিই মহাকালের ধনুকে ছিলা পরিয়ে টঙ্কার দিই যুগে যুগে অশুভের বুকে অব্যর্থ শব্দভেদী বাণ হয়ে ছিন্নভিন্ন করি উদ্ধত অহংকারকে।"
যে কন্যা প্রকৃতির মাঝে আপনাকে আর আপনার মাঝে বিশ্বসংসারকে ধারণ করে, যে কন্যা দস্যু রত্নাকরের মুখে ভাষা প্রদান করে, "মা নিষাদ" উচ্চারণে সে হয় মহির্ষী বাল্মীকি আমিই সেই মানবী। পুরুষোত্তমকে অধিকার করি আমিই সেই নারী যে কবির কলমের বিনিদ্র যন্ত্রণা নিবারণ করে, বীণাধরের চঞ্চল অঙ্গুলিতে বীণাপাণি। আমিই ব্রহ্মাণ্ডপ্রসবিনী মহাকালের হৃদকমলের আদিতম স্রষ্টা। বিশ্বের অতীত আমি, শিবের জটায় গঙ্গা, মহেশ্বরের পার্বতী, সৃষ্টি- স্থিতি- প্রলয়ে আদ্যাশক্তি মহামায়া। মহাকালের রণাঙ্গনে আমিই সেই পরমেশ্বরী!!
অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোমা।।
সূত্র: দেবী সুক্ত ঋগবেদ
No comments:
Post a Comment
Please do not any spam in the comments Box.