নবাব বাড়ী বগুড়া- Nawab's house is in Bogra
নানা বই, দলিলপত্র ও লোকমুখে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ারের জমিদার বংশে সৈয়দ আব্দুস সোবহান চৌধুরী জন্ম নেন।
বৈবাহিক সূত্রে তিনি বগুড়ায় বসবাস শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার জনহিতকর কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ তাকে ১৮৮৪ সালের ২০ মার্চ 'নওয়াব' উপাধি দেন।
ব্রিটিশ শাসনামলে তিনি নওয়াবের মর্যাদা নিয়ে বগুড়ায় অবস্থান করেন। বগুড়া শহরের করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে নওয়াবের জন্য প্রাসাদ বানানো হয়।
নবাববাড়ীর সামনের সড়কটিকে বলা হয় নবাববাড়ী সড়ক। প্রাসাদটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। তার সময়ে তিনি বগুড়া অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে জমি দেয়াসহ আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন। বগুড়ার উন্নয়নে তিনি নিজের জমিতে অনেক কিছু তৈরি করেন। তিনি সান্তাহার থেকে লালমনিরহাট রেল সড়ক বানাতে নিজের জমি দিয়ে দেন।
সৈয়দ আব্দুস সোবহান চৌধুরী ছিলেন টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ি এলাকার বিশিষ্ট জমিদার। তিনি বগুড়ার মানিকপুর এলাকার মীর সারোয়ার আলীর বোন তহুরুন নেছাকে বিয়ে করেন। স্ত্রী তহুরুন নেছা মারা গেলে তিনি জমিদারি লাভ করেন।
তিনি জমিদারি লাভের পর বগুড়া অঞ্চলে শিক্ষা ও সাধারণ মানুষের জন্য সেবামূলক নানা ব্যাবস্থা করেন। সেই সুবিধা বগুড়ার মানুষ এখনও ভোগ করছেন।
এছাড়াও তিনি বগুড়া সেন্ট্রাল হাই স্কুল, উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি ও হাসপাতাল তৈরি করেন।
লাইব্রেরিটি এখনও আছে। হাসপাতালের বদলে তৈরি হয়েছে তহুরুন নেছা মহিলা পরিষদ।
তার মেয়ে আরতাফুন্নেছার বিয়ে হয় টাঙ্গাইলের জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী।
আর ছেলে আলতাফ আলীর সংসারে আসে মোহাম্মদ আলী। পরবর্তীতে মোহাম্মদ আলী তৎকালীন পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৩৪ সালে মোহাম্মদ আলী বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এলাকার লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ হোসেনের কন্যা হামিদা বানুকে। তিনি ১৯৫৩ সালের ১৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী হন।
তার নামে বগুড়ায় রয়েছে মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল, আরতাফুন্নেসা খেলার মাঠ, সার্কিট হাইস, দেড়শ বছরের পুরনো বগুড়া জেলা স্কুল। বগুড়া জেলা প্রশাসনের অফিস হতে আংশিক জায়গা দেয়াসহ বগুড়াকে বিভিন্নভাবে আধুনিক করার চেষ্টা ছিল এই পরিবারের।
বগুড়ার নবাববাড়ির ইতিহাস ছিল রুপকথার মতো। বর্তমানে সেই অতীত ইাতহাস বিলীন হতে চলেছে।
মোহাম্মদ আলীর ছোট পুত্র হামদে আলী নবাব প্রাসাদের দায়িত্বে আছেন। তিনি নবাব ইতিহাস নিয়ে 'মোহাম্মদ আলী প্যালেস মিউজিয়াম অ্যান্ড পার্ক' জাদুঘর তৈরি করেছেন।
নবাবি আমলের সভ্যতা, কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্য কয়েকজন শিল্পীর শ্রম ও মেধায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই জাদুঘরটি।
দেশের উত্তর জনপদের কেন্দ্রস্থল বগুড়া শহরের প্রানকেন্দ্র করতোয়া নদীর পশ্চিম তীর ঘেষে নবাব প্যালেসের ভিতরে তৈরি করা হয়েছে এই পার্ক। এ পার্কে নবাববাড়ির পাইক, পেয়াদা বরকন্দাজের মডেল তৈরি করে রাখা হয়েছে।
নবাব প্যালেসে ঢুকতে গিয়ে প্রায় দুশো বছর আগের বিশাল নকশা করা কাঠের দরজা দেখে ভড়কে যেতে পারেন। মনে হতে পারে এই বুঝি নবাবের কোন দারোয়ান ছুটে আসছে কোন ফরমায়েশ নিয়ে।
ভাবলেই কেমন গা ছমছম করে উঠে। পুরনো প্যালেসটি বিশাল এক জাদুঘর। বিনোদন কেন্দ্র, জোড়া ঘোড়ার গাড়ি, কোচোয়ানদের হাতে চাবুক।
বগুড়ার নবাববাড়ির অতীত দিনের নেপালি দারোয়ান, মালি, পালকি, বেহারা, কোচোয়ান, টমটম, সিংহ, বাঘ, কুমির, ময়ূর, রাজহাঁসসহ নানা পাখির প্রতিমূর্তি তৈরি করে রাখা হয়েছে।
নবাববাড়ি বিরাট হলরুমের দেয়ালে টানান রয়েছে নবাব আব্দুস সোবহান চৌধুরী, নবাবজাদা আলতাফ আলী চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ তহুরুননেসা চৌধুরানী, সৈয়দ আলতাফুননেছা চৌধুরানীর ছবি।
নবাব আমলের এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে শিল্পী আমিনুল করিম দুলাল প্রথম ব্যবস্থা নেন। তাদের এই পরিকল্পনার ফলে নবাববাড়িটি যেমন রক্ষা পেয়েছে তেমনি এটি একটি দর্শনীয় জায়গায় পরিণত হয়েছে।
নবাববাড়ির অতিথি আপ্যায়ণ, বিলিয়ার্ড খেলা, পড়ার ঘরে সাজান বই, জলসা ঘরে জলসার দৃশ্য, নায়েবের খাজনা আদায়সহ অনেক দৃশ্যকেই জীবন্ত করে তোলা হয়েছে।
এছাড়া নবাব প্যালেস পার্কে শিশুদের বিনোদনের জন্য মিনি ট্রেন ভ্রমণ, কৃত্রিম বিমান ভবন, দোলনা, স্লিপার, ঢেকি, কৃত্রিম পশুপাখি তৈরি করা হয়েছে।
পার্কে গড়ে উঠেছে শিশু কিশোরদের খাবার ও খেলনার দোকান। দেশের একমাত্র শতবর্ষি কর্পুরের গাছ রয়েছে এ নবাববাড়িতে। বিশাল এ গাছটি দেখতে দেশের বিভিন্ন জায়গার মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র – শিক্ষক এখনও ভিড় জমান।
১৯৯৮ সালের মে মাসে মোহাম্মদ অলী প্যালেস মিউজিয়াম অ্যান্ড পার্ক বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। টিকেট কিনে মূল গেট পার হতে হয়।
নবাববাড়ির সাথে শিল্পী আমিনুল করিম দুলাল কারুপল্লী নামের একটি স্টুডিও তৈরি করেন। আদিম মানুষের জীবন যাত্রা নিয়ে গড়ে উঠা এই স্টুডিওটি আর নেই।
ইতিহাসের সাক্ষী এখন শুধু গড়ে উঠা এই মিউজিয়ামটি।
No comments:
Post a Comment
Please do not any spam in the comments Box.