Golpo Kotha Live

Jun 5, 2021

ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তন : সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতা Evolution of Indian Civilisation

ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তন : সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতা
Evolution of Indian Civilisation
ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তন : সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতা Evolution of Indian Civilisation

ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তন : সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতা
Evolution of Indian Civilisation

শুরুতে নারীরা ছিলেন স্বল্পবসনা। ছিলো শুধু দুই টুকরা কাপড়। তখন নারীরা অল্প কিছু কাপড় পরতো।
মৌর্য এবং সুঙ্গ যুগে (৩০০খৃস্টাব্দ) নারী ও পুরুষেরা চারকোনা কাপড় পরতো। শরীরের নিচের দিকে কাপড়কে বলতো অন্তরীয় এর উপরের অংশকে উত্তরীয়।

শালীন পোশাক বলতে তখন একটা ভিন্ন অর্থ ছিলো। শুধু মুখ আর শরীর ঢেকে রাখার মধ্যেই তা সীমিত ছিলো না। ভারতের উষ্ণ আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখেই মানুষ কাপড় পরতো।

এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একেক রকমের কাপড় পরতো।

দক্ষিণ ভারতে, এমনকি ঔপনিবেশিক আমলেও, কোনো কোনো নারী তাদের শরীরের ওপরের অংশ ঢেকে রাখতো না।
তারপর পোশাক আশাকে গ্রিক, রোমান, আরব এবং চীনা প্রভাব পড়তে শুরু করলো।

১৫শ শতাব্দীতে হিন্দু মুসলিম নারীরা আলাদা রকমের পোশাক পরতো।
কি ধরনের কাপড় পরতে হবে তার লিখিত কোনো নির্দেশনা ছিলো না।

তবে মুসলিম নারীরা সাধারণত নিজেদেরকে ঢেকে রাখতো। সেজন্যে তারা আলাদা আলাদা কয়েকটি কাপড় পরতো যেখানে থেকে সালওয়ার কামিজের জন্ম।

কিন্তু ভিক্টোরিয়ার আমলে, বিশেষ করে বাংলায়, যখন কোনো কোনো নারী তাদের শাড়ির নিচে ছোট্ট ব্লাউজ পরতো না, তখন তাদের বক্ষ উন্মুক্ত থাকতো।
কিন্তু সেটা ভিক্টোরিয়ান সমাজের সাথে যুৎসই ছিলো না। তখন ব্লাউজের প্রচলন শুরু হলো।

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জনদানন্দিনী দেবী আজকে যেভাবে ব্লাউজ পরা হয় তার ধারণা তৈরি করেন, কারণ শাড়ির নিচে নগ্ন বক্ষের কারণে তাকে ব্রিটিশ রাজের আমলে তাকে ক্লাবে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

ভিক্টোরিয়ানরা চাইতো নারীরা ব্লাউজ পরুক।
সেখান থেকেই আজকের ব্লাউজ ও পেটিকোটের সূচনা।
ভারতীয় নারীদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কাপড় দিয়ে শরীর ঢেকে রাখা। কিন্তু তার নিচে কি আছে সেটা কোনো বিষয় নয়।

তারপর সময়ের সাথে ব্রিটিশ প্রভাব বাড়তে লাগলো।
চালু হলো নানা ধরনের ব্লাউজের চল।
ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তন : সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতা Evolution of Indian Civilisation

(১) পুরাপ্রস্তর যুগ (Palaeolithic Age):
(২) মধ্যপ্রস্তর যুগ (Mesolithic Age):  
(৩) নব্যপ্রস্তর যুগ (Neolithic Age):

►মেহেরগড় সভ্যতা [Mehrgarh civilisation]
(১) অবস্থান [Location of Mehrgarh civilisation]:
(২) সময়কাল:
(৩) সভ্যতার বৈশিষ্ঠ:[Characteristics of  Mehrgarh civilisation] :
(৪) মেহেরগড় সভ্যতার গুরুত্ব :

►ধাতুর আবিষ্কার ও তাম্রযুগ:-
►সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা:-

আবিষ্কার:
►সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ঠ:
(১) নাগরিক চরিত্র ও নগর পরিকল্পনা :
(২) অর্থনৈতিক জীবন-
(ক) কৃষি :  (খ) পশুপালন :  (গ) ব্যবসাবাণিজ্য :  (ঘ) কারিগরি শিল্প :
(৩) সামাজিক জীবন :
(৪) ধর্মীয় জীবন :

►সিন্ধু সভ্যতার সমস্যা :
(১) সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি :
(২) সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা :
(৩) সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা :
(৪) সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ [Causes of decline of the civilisation]:

►সমকালীন সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক [Relation with contemporary civilisations]:
বৈদিক সভ্যতা [Vedic Civilisation]:
►উদ্ভব ও বিবর্তন:
►বৈদিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য [Features of vedic civilisation]:
►হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক সভ্যতার সম্পর্কঃ
►আর্যদের পরিচয় :
►আর্যদের বসতি বিস্তার :
ঋকবেদের আলোকে আর্য জনজীবন: 
►রাজনৈতিক জীবন : [Political life of the Aryans]
►সামাজিক জীবন-­­­­­­­­­­­[Social life of the Aryans]
(১) পারিবারিক জীবন:
(২) পোশাক পরিচ্ছদ :
(৩) খাদ্য :
(৪) আমোদপ্রমোদ:
(৫) সামাজিক কাঠাম :

►আর্যদের অর্থনৈতিক জীবন- [Economic life of the Aryans]
(১) কৃষি ও পশুপালন : [Agriculture and Animal husbandry]
(২) ব্যবসাবাণিজ্য:[Trade]
(৩) শিল্প : [Industry]

►আর্যদের ধর্মজীবন: [Religious life of the Ariyans]
►পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্য জনজীবনে পরিবর্তন:
(ক) রাজার ক্ষমতা: 
(খ) সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন :
(গ) অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তন :
(ঘ) ধর্ম ও ধর্মীয় আচারে পরিবর্তন :

►বৈদিক সাহিত্য [Vedic literature]:
►প্রাচীন ভারতে বাণিজ্যের প্রসার [Expansion of Trade in ancient India]
►নগরের উত্থান
►শ্রেণি ও জাতি বিন্যাস
►প্রতিবাদী আন্দোলন [Protest Movement]
(১) প্রতিবাদী আন্দোলনের কারণ
     (ক) ধর্মীয় কারণ :   (খ) সামাজিক কারণ :   (গ) অর্থনৈতিক কারণ :
(২) জৈনধর্মের উত্থান ও আদর্শ
     (ক) জৈনধর্মের প্রবক্তা:   (খ) জৈন ধর্মগ্রন্থ ও আদর্শ :  (গ) জৈনধর্মের প্রসার :
(৩) বৌদ্ধধর্মের উত্থান ও আদর্শ:
    (ক) গৌতম বুদ্ধের জীবন:    (খ) বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ:   (গ)  বুদ্ধের ধর্মমত:   (ঘ) বৌদ্ধধর্মের প্রভাব :
ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তন : সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতা Evolution of Indian Civilisation
ভারতে প্রথম কবে মানুষ বসবাস শুরু করে, সঠিকভাবে তা বলা যায় না । মধ্যপ্রদেশের হোসংগাবাদ শহরের নিকটবর্তী হাথনোরা গ্রামের কাছে ভারতের প্রাচীনতম মানুষের নিদর্শনটি পাওয়া গেছে । এর সময় সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয় নি। অনুমান করা হয়েছে এর বয়স বড়োজোর ৫ লক্ষ বছর হবে । প্রাক্‌ঐতিহাসিক যুগের কোনো লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না । কারণ তখন মানুষ লিখতে পড়তে জানত না । একমাত্র তাদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র থেকে তাদের কথা জানতে পারা যায় । তখন মানুষ পাথরের সাহায্যে যন্ত্রপাতি তৈরি করত বলে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই যুগকে ‘প্রস্তর যুগ’ [Stone Age] বলে অভিহিত করেছেন । প্রস্তর যুগকে আবার তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে ,যথা- (১) পুরাপ্রস্তর যুগ (Palaeolithic Age বা  Old Stone Age),  (২) মধ্যপ্রস্তর যুগ (Mesolithic Age বা Middle Stone Age), ও  (৩) নব্য প্রস্তর যুগ (Neolithic Age বা New Stone Age) ।

 (১) পুরাপ্রস্তর যুগ (Palaeolithic Age বা Old Stone Age)
পুরাপ্রস্তর যুগের বিবর্তন দীর্ঘকাল জুড়ে চলেছিল । আনুমানিক ১০,০০০ বছর আগে, অর্থাৎ, ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পুরাপ্রস্তর যুগ শেষ হয় । এ সময় মানুষ চাষাবাদ করতে জানত না । তারা ছিল যাযাবর; ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াত । গাছের ফল ও পশুর মাংস ছিল তাদের প্রধান খাদ্য । এ সময় মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী । চাষবাস করে ফসল ফলাতে বা উৎপাদন করতে জানত না । পশু শিকারের  জন্য তারা নানা ধরনের পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করত । গঙ্গা, যমুনা ও সিন্ধু উপত্যকার সমভূমি বাদ দিলে সারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে এগুলির নিদর্শন পাওয়া গেছে । এগুলির মধ্যে হাত কুঠার ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ । পশ্চিম পাঞ্জাবের সোয়ান নদীর অববাহিকায় হাত কুঠারের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
 
(২) মধ্যপ্রস্তর যুগ (Mesolithic Age বা Middle Stone Age)
ভারতে মধ্যপ্রস্তর যুগ আনুমানিক ৮০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল । তবে ভারতের বাইরে অন্য অনেক জায়গায় এই যুগ অনুপস্থিত । সেইসব জায়গায় পুরাপ্রস্তরের পর সরাসরি নব্যপ্রস্তর যুগ শুরু হয় । এই সময়ও মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী, খাদ্য উৎপাদক নয় । কারণ তখনও পর্যন্ত মানুষ চাষ-আবাদ করতে শেখেনি । তবে পাথরের অস্ত্রগুলি এই সময় আয়তনে ছোটো হয়ে যায় । এই সময়ের অস্ত্রগুলিকে মাইক্রোলিথ (Microlith) বলা হয়; অর্থাৎ, ছোটো, শক্ত ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ত্রিকোণাকার । মৃৎশিল্পে ও চিত্রশিল্পেও মানুষ বেশ পটু হয়ে উঠে । মধ্যপ্রদেশের ভিমবেটকার গুহাচিত্র এ সময়ের উল্লেখ্য চিত্রশিল্পের নিদর্শন।

 (৩) নব্যপ্রস্তর যুগ (Neolithic Age বা New Stone Age) :
Neolithic age আঞ্চলিক বৈষম্যগুলি ধরে মোটামুটিভাবে বলা যায়, খ্রি.পূ.৪০০০ অব্দ থেকে ভারতে নব্যপ্রস্তর যুগ শুরু হয় । মানুষ এ সময় কৃষিকাজ ও পশুপালন আয়ত্তে আনে এবং খাদ্য উৎপাদক হয়ে ওঠে । কাজেই মানুষ ক্রমশ: যাযাবরবৃত্তি ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে । মাটি ও বাঁশ দিয়ে ঘর তৈরি করা শিখে নেয় । বস্ত্রবয়ন শিল্প বিকশিত হয় । মৃতশিল্পের উন্নতি হয় । অস্ত্র ও যন্ত্রপাতিও আগের তুলনায় অনেক উন্নত, মসৃণ ও মজবুত হয় । আগুনের ব্যবহারেও মানুষ সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে । মেহেরগড় এ যুগের সভ্যতা ।

মেহেরগড় সভ্যতা
Mehrgarh Civilisation
হরপ্পা সভ্যতার আগে নব্যপ্রস্তর যুগের যে সব কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে মেহেরগড় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । হরপ্পা সভ্যতার কিছু কিছু লক্ষণ এই সভ্যতার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় বলে অনেকে এই সভ্যতাকে আদি সিন্ধু সভ্যতা বলে অভিহিত করেছেন ।

 (১) অবস্থান (Location of Mehrgarh Civilisation):  বালুচিস্তানের কাচ্চি সমতলভূমিতে বোলান নদীর পাড়ে কোয়েটা শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে মেহেরগড়ের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে । জ্যাঁ ফ্রাসোয়া জারিজ -এর নেতৃত্বে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন । এই সভ্যতার প্রধান কেন্দ্রগুলি হল কিলে গুল মহম্মদ, কোট ডিজি, গুমলা, মুন্ডিগাক, রানা ঘুনডাই, আনজিরা এবং মেহেরগড়।

(২) সময়কাল: প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে আনুমানিক ৭০০০ খ্রিস্টপূবাব্দে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল । এই সভ্যতা বহু বছর স্থায়ী হয়েছিল বলে মনে করা হয় ।

(৩) সভ্যতার বৈশিষ্ঠ (Characteristics of  Mehrgarh Civilisation) : মেহেরগড়ের খনন কার্যের ফলে যে সব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে চাষবাসের কিছু প্রমাণ মিলেছে এবং বহু দূর দেশের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যের সম্পর্কের প্রমাণও পাওয়া যায় । এখানকার মানুষ যে ঘরবাড়ি তৈরি করে গ্রাম স্থাপন করেছিল, প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যে তার প্রমাণ মেলে ।

(ক) প্রাচীনতর পর্যায়ে একাধিক ঘর নিয়ে বাড়ি তৈরি করা হত । এইসব বাড়ি তৈরি হত রোদে শুকানো ইটের সাহায্যে । এই সময় তারা চাষবাস, পশুপালন ও শিকার করত । মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হত এবং কোঁকড়ানো অবস্থায় সমাধিস্থ মৃতদেহ পাওয়া গেছে ।

(খ) পরের দিকে কৃষিকার্য ও পশুপালনের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায় । এই সময় তারা মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার করতে শুরু করেছিল । বাড়িগুলিও আকারে বড়ো হয়েছিল । এইসব বাড়ি থেকে ছোটো শিলনোড়ার পাথর, উনুন, হাড় দিয়ে তৈরি হাতিয়ার ইত্যাদি জিনিস পাওয়া গেছে । সমাধির মধ্যে যে সব জিনিস পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ঝিনুকের তৈরি লকেট, পুঁতি ও  ঝিনুক জাতীয় জিনিসের মালা, পাথরের লকেট, হাড়ের আংটি, পালিশ করা পাথরের কুডুল ইত্যাদি প্রধান । তখনকার মানুষ যব, গম, কুল, খেজুর ইত্যাদি চাষ করত । জন্তুজানোয়ারের মধ্যে হরিণ, হাতি, নীলগাই, বুনো ভেড়া ও ছাগল, শুয়োর, গোরু ইত্যাদির হাড় পাওয়া গেছে । গরু, ভেড়া, ছাগল এবং সম্ভবত কুকুরও পোষ মানানো হত । শুধু চাষবাস বা পশুপালন এখানকার মানুষের উপজীবিকা ছিল না । ব্যবসা বাণিজ্যও করত । এখানে পাওয়া সামুদ্রিক ঝিনুক থেকে মনে হয় সমুদ্র উপকূলবর্তী স্থানের সঙ্গে এদের ব্যাবসাবাণিজ্য চলত । মেহেরগড়ে যে সব পাথর পাওয়া গেছে তা থেকে মনে হয়, তাদের বাণিজ্য অন্তত তুর্কমেনিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । পাথর দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র বা জিনিসপত্র তৈরি হত । ধাতুর ব্যবহার অজ্ঞাত হলেও, সমাধি থেকে তামার তৈরি একটি পুঁতি পাওয়া গেছে । এখানে পাথরের তৈরি কুড়ুল পাওয়া গেছে ।

(৪) মেহেরগড় সভ্যতার গুরুত্ব (Importance of Mehrgarh Civilisation): মেহেরগড় সভ্যতার আবিষ্কার কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ । প্রথমত, এখানে গম ও যব চাষের যে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা থেকে বোঝা যায় যে, এই দুটি শস্যের সূত্রপাত পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতে আমদানি করা হয়নি । দ্বিতীয়ত, এই সভ্যতা নব্যপ্রস্তর যুগের হলেও তামা, সিসা প্রভৃতি ধাতুও পুরোপুরি অজ্ঞাত ছিল না । তৃতীয়ত, এখানকার মানুষ দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য করত । চতুর্থত, এখানে কাঁচা মাটি দিয়ে পুরুষমূর্তি ও পোড়া মাটির নারীমূর্তি পাওয়া গেছে । তবে এই সব মূর্তির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কতটুকু ছিল, তা সঠিক ভাবে বলা যায় না । পরিশেষে, এই সভ্যতার আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, সিন্ধু সভ্যতার আগে নব্যপ্রস্তর যুগে বালুচিস্তান অঞ্চলে একটি মোটের উপর উন্নত গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা ছিল। এই জন্য অনেকে এই সভ্যতাকে আদি সিন্ধু সভ্যতা বলে অভিহিত করেছেন ।
ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তন : সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতা Evolution of Indian Civilisation
নব্য প্রস্তর যুগের অবসান হওয়ার পর ধাতুর ব্যবহার শুরু হয় । তবে কোথায় নব্যপ্রস্তর যুগের অবসান আর কোথায় ধাতব যুগের সূত্রপাত তা সঠিক ভাবে বলা যায় না । নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে ধাতব যুগের উত্তরণ হয়েছিল খুব ধীরে ধীরে । ধাতুর ব্যবহার ভারতের সর্বত্র একসঙ্গে হয়নি । উত্তর ভারতে প্রস্তর যুগের শেষ দিকে মানুষ তামার ব্যবহার শিখেছিল । তবে পাথরের ব্যবহার ও গুরুত্ব তখনও অব্যাহত ছিল । তাই এই যুগকে তাম্র-প্রস্তর যুগ বা (Chalcolithic Age) বলে । সিন্ধু সভ্যতা এই যুগের সভ্যতা । তামার পর ধীরে ধীরে লোহার প্রচলন শুরু হয় । অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে প্রস্তর যুগের পরেই লৌহ যুগ শুরু হয় । ভারতে কোথাও ব্রোঞ্জযুগের কোনো উল্লেখযোগ্য নিদর্শন পাওয়া যায় না ।

The Indus Valley Civilization or the Harappan Civilization
আবিষ্কার : ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত নিদর্শন আবিষ্কার করেন । তিনি জন মার্শালের তত্ত্বাবধানে সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেন-জো-দরোতে মাটি খুঁড়ে ভারতীয় সভ্যতার উন্মেষকে কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে দেন । প্রায় একই সময়ে দয়ারাম সাহানি পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলার হরপ্পায় এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন । পরবর্তীকালে মার্টিমার হুইলার, রফিক মুঘল, ম্যাকে, রেইকস্‌, দিলীপকুমার চক্রবর্তী প্রভৃতি সিন্ধু সভ্যতার উপর ব্যাপক গবেষণা চালান । বর্তমানে মহেন-জো-দরো, কালিবঙ্গান, কোটডিজি, বনোয়ালি, লোথাল, ধোলিবিরা প্রভৃতি নানা স্থানে এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে । সিন্ধু সভ্যতার অসংখ্য কেন্দ্র আবিষ্কৃত হলেও শহর বলতে অবশ্য মাত্র পাঁচ-ছয়টি বোঝায় । কিন্তু কোনো লিখিত সাহিত্যিক উপাদান পাওয়া যায়নি বলে এর রাজনৈতিক ইতিহাস কিছুই জানা যায় না । সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি বলে এর ধ্বংসাবশেষ থেকেই এর পরিচয় পাওয়া যায় । সিন্ধু জনগণ পাথর ও তামা উভয়েরই ব্যবহার জানত । এই সভ্যতা কারা নির্মাণ করেছিল তা আজও রহস্যাবৃত । সম্ভবত ভারতীয়রাই এই সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল । এই প্রাচীন সভ্যতার সময়সীমা সম্ভবত খ্রিস্টপূব ২৫০০ অব্দ থেকে ১৫০০ অব্দ পর্য়ন্ত (পরিণত পর্য়ায়) স্থায়ী ছিল ।

সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ঠ (The main features of the Harappan Civilisation) :
(১) নাগরিক চরিত্র ও নগর পরিকল্পনা (Urban Culture and Town-Planning) : সিন্ধু সভ্যতা নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল । এই সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ঠ ছিল উন্নত মানের নগর পরিকল্পনা ও গৃহনির্মাণশৈলী । নগরগুলির মধ্যে হরপ্পা ও মহেন-জো-দরো উল্লেখযোগ্য । নগরগুলির পরিকল্পনা ছিল প্রায় একই ধরনের । নগরগুলি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল- দূর্গ ও সাধারণ মানুষের জন্য নীচের শহরাঞ্চল । দূর্গগুলি ইটের তৈরি, উঁচু চাতালের উপর অবস্থিত এবং মূল শহর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল । ফলে শহরে বন্যা হলেও দূর্গে জল ঢুকত না । শাসকশ্রেণি এখানেই বাস করত । মহেন-জো-দরোতে একটি বিশাল স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়েছে । এটি উত্তর-দক্ষিণে ১১.৮৯ মি., পূর্ব-পশ্চিমে ৭.০১ মি. এবং গভীরতা ২.৪৪ মি. । জলাশয়ের তিন দিকে খোলা বারান্দা । তারপর ঘর । জলাশয়টিতে জল ভর্তির জন্য একটি ঘরে ইট দিয়ে বাঁধানো কূপ ছিল । পৃথিবীর আর কোথাও এত বড়ো স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়নি । আর একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল ৪৫.৭২ × ২২.৮৬ মি. জায়গা জুড়ে এক শস্যাগার ।

শহরে নগর পরিকল্পনা ছিল অত্যন্ত উন্নতমানের । শহরের রাস্তাগুলি উত্তর-দক্ষিণে এবং পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত ছিল । রাস্তাগুলি প্রায় সোজা ও দশ মিটার চওড়া । ছোট ছোট সরু গলিপথ এইসব রাস্তায় এসে মিশত । রাস্তার দু-ধারে ছিল বড়ো বড়ো তিনতলা পর্যন্ত বাড়ি । আগুনে পোড়া ইট দিয়ে বাড়িগুলি তৈরি হত । সিন্ধুবাসী কাঠের তৈরি দরজা ব্যবহার করত । কিন্তু জানালার কোনো ব্যবস্থা ছিল না । দেওয়ালের উপরে ছিদ্র দিয়ে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা ছিল । প্রত্যেক বাড়িতে রান্নাঘর ও উঠনের জন্য স্থান সংরক্ষিত ছিল । শহরের গরিব ও খেটে-খাওয়া মানুষ ছোটো ছোটো অস্বাস্থ্যকর কুঁড়েঘরে বাস করত । এইসব এলাকা ছিল বস্তিতুল্য । নগর পরিকল্পনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় শহরবাসীর মধ্যে ব্যপক ধনবৈষম্য ছিল । শহরে জল সরবরাহ ও নিকাশি ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের । প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই নিজস্ব কূপ ছিল । তা ছাড়া জনগণের ব্যবহারের জন্য রাস্তাতেও কূপ খনন করা হত । ময়লা জল বার করার জন্য প্রত্যেক বাড়িতেই নর্দমার ব্যাবস্থা ছিল এবং সেই জল রাস্তার বড়ো নর্দমায় পড়ত । রাস্তার ধারে গর্ত করে নর্দমা তৈরি করা হত এবং তা নিয়মিত পরিষ্কার করা হত । অধ্যাপক এ.এল.বাসামের মতে রোমান সভ্যতার আগে অন্য কোনো সভ্যতায় এত উন্নত মানের পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল না । গবেষক ডি.ডি. কোশাম্বি মনে করেন- উন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থাই হরপ্পাকে মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা থেকে পৃথক করেছে । অধিকাংশ শহরের পরিকল্পনা প্রায় এক ধরনের হলেও লোথালের বৈশিষ্ঠ হল- এখানে একটি পোতাশ্রয় ছিল।

(২) অর্থনৈতিক জীবন (Economic Life) -
(ক) কৃষি [Agriculture] : সিন্ধু সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক হলেও অধিকাংশ মানুষ গ্রামে থাকত । কৃষিই ছিল প্রধান উপজীবিকা । গম, জব, সরিষা, তিল প্রভৃতি ছিল প্রধান শস্য । সিন্ধু জনগণ সম্ভবত ধানের চাষ করত না । তবে লোথালে ধানের নিদর্শন পাওয়া গেছে । সিন্ধুনদের বন্যার জল জমিকে উর্বর করত । জলসেচের ব্যাবস্থাও ছিল। অনেকের মতে, তারা লাঙলের ব্যবহার জানত না । এই ধারনা সত্য নয় । কালিবঙ্গানে লাঙল ব্যবহারের চিহ্ন পাওয়া গেছে ।

(খ) পশুপালন [Animal Husbandry]: কৃষিকার্যের পাশাপাশি সিন্ধুজনগণ পশুপালন করত । মেষ, গোরু, ছাগল, কুকুর ছিল প্রধান গৃহ পালিত পশু । তারা হাতিকেও পোষ মানাত; তবে ঘোড়ার ব্যবহার জানত কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে । দিলীপকুমার চক্রবর্তী মনে করেন ঘোড়াও গৃহ পালিত জন্তু ছিল । গাধা ও উট ছিল ভারবাহী পশু ।

(গ) ব্যবসাবাণিজ্য [Trade and Commerce] : অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল তাদের উপজীবিকা । মাল পরিবহণের জন্য দু-চাকার গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। স্থল ও জল উভয় পথেই ব্যবসা চলত । লোথালে একটি পোতাশ্রয় ছিল । হরপ্পার সঙ্গে মেসোপটেমিয়ার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল । জলপথে নৌকা ব্যবহার করা হত । তামা, ময়ূর, হাতির দাঁত, চিরুনি, বস্ত্র প্রভৃতি ছিল প্রধান রপ্তানি দ্রব্য । আমদানি হত রুপো ও অন্যান্য ধাতু । সিলমোহর গুলি সম্ভবত বাণিজ্যের কাজে ব্যবহৃত হত । তবে সিন্ধু জনগণ মুদ্রার ব্যবহার জানত না । সম্ভবত বিনিময় প্রথার মাধ্যমে কেনাবেচা হত।

(ঘ) কারিগরি শিল্প [Handicraft] : শহরের জনগণের একটা বড় অংশ ছিল শিল্পী ও কারিগর । বস্ত্রবয়ন শিল্প ছিল খুবই উন্নত। তাছাড়া অনেক মানুষ মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প ও অলঙ্কার শিল্পেও নিযুক্ত ছিল । সোনা ও রুপো উভয় প্রকারের অলংকারেরই প্রচলন ছিল । গুজরাট ও রাজপুতানা থেকে দামি পাথর আনা হত এবং এগুলি অলঙ্কার নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হত । তাছাড়া কাস্তে, কুঠার, বর্শা, ছুঁচ, ইত্যাদিও তৈরি হত । এই সব দ্রব্য তৈরি করতে তামা ও ব্রোঞ্জ ব্যবহৃত হত । লোহার ব্যবহার সিন্ধু জনগণ জানত না । তবে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্বে লোথালে লোহার ব্যবহারের কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে । কিন্তু লোহার ব্যাপক প্রচলন ছিল না।

(৩) সামাজিক জীবন [Social Life]: সিন্ধু সমাজে ধনবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্য প্রকট ছিল । সিন্ধু সমাজ বিভিন্ন গোষ্টীতে বিভক্ত ছিল, যথা- পুরোহিত সম্প্রদায়, বণিক, কৃষক, দক্ষকারিগর এবং শ্রমিক । সিন্ধু জনগণের জীবনযাত্রার মান খুব উন্নত ছিল । তাদের প্রধান খাদ্য ছিল গম, যব, তরি-তরকারি ও খেজুর । তা ছাড়া তাদের খাদ্য তালিকায় মাছ, মাংস ও ডিমও অন্তর্ভুক্ত ছিল । সুতিবস্ত্র ছিল তাদের প্রধান পোশাক। শীতের দিনে তারা পশমের পোশাক পরত । নারী-পুরুষ উভয়েই অলংকার পরত । সিন্ধু জনগণ যেসব জিনিস ব্যবহার করত, তার মধ্যে মাটির তৈরি নানা বাসন, যেমন- থালা, জালা, কলসি, বাটি ইত্যাদি প্রধান । কখনো-কখনো এইসব মাটির পাত্রে নানারকম আলপনা আঁকা থাকত । এ ছাড়া তামা, রুপো, ব্রোঞ্জ ও চিনামাটির তৈরি জিনিসপত্রও পাওয়া গেছে । ছুরি, হাতির দাঁত অথবা হাড়ের তৈরি চিরুনি, কাস্তে, কুড়ুল, চারচৌকো পাথর (ওজনের মাপ) ইত্যাদিও ব্যবহৃত হত । সিন্ধু জনগণ লেখাপড়া জানত; যার প্রমান লিপি । সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার অবশ্য আজও হয়নি । সিন্ধু জনগণ মৃত দেহ কবর দিত । তবে কখনও মৃতদেহের কঙ্কাল আবার কখনও মৃত দেহ দাহ করে তার ছাই কবর দেওয়া হত । কবরের মধ্যে মৃতের ব্যবহার্য জিনিসও দেওয়া হত ।

(৪) ধর্মীয় জীবন [Religious Life] : সিলমোহরে খোদিত মুর্তি থেকে সিন্ধু জনগণের ধর্মজীবনের আভাস পাওয়া যায় । সিন্ধুজনগণের মধ্যে মাতৃপূজার প্রচলন ছিল । তা ছাড়া যোগাসনে ধ্যানমগ্ন পশুপরিবেষ্টিত তিনমুখবিশিষ্ট একটি পুরুষ দেবমূর্তিও পাওয়া গেছে । এই মুর্তির সঙ্গে শিবের সাদৃশ্য আছে, তাই মার্টিমার হুইলার এই দেবতাকে শিবের পূর্ব সংস্করণ বলে মনে করেন । কয়েকটি শিব লিঙ্গের আবিষ্কার এই অনুমানকে জোরদার করেছে । মূর্তিপূজা ছাড়া শক্তির আরাধ্যরূপে পাথর, গাছ ও জীবজন্তুর পূজাও প্রচলিত ছিল । তবে কোথাও মন্দিরের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি ।

সিন্ধু সভ্যতার সমস্যা (The Problem of the Harappan Civilisation):
সিন্ধু সভ্যতাকে কেন্দ্র করে চারটি সমস্যা আছে- (১) বিস্তৃতি,  (২) নির্মাতা,  (৩) সময়সীমা এবং  (৪) অবলুপ্তি ও ধ্বংসের কারণ । এর মধ্যে প্রথমটি ছাড়া বাকি সমস্যাগুলির সমাধান এখনও হয়নি । তিনটি প্রশ্নই অত্যন্ত বিতর্কিত।

প্রথম প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই, কারণ এ যাবত যেসব কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের অবস্থান থেকে সিন্ধু সভ্যতার সীমানা সম্পর্কে একটা ধারনা করা যায় । এর অর্থ অবশ্য এটা নয় যে, বর্তমান সীমারেখাই চূড়ান্ত । ভবিষ্যতে নতুন নতুন কেন্দ্র আবিষ্কৃত হলে এই সিমা রেখা অবশ্যই পালটে যাবে ।

(১) সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি (The Extent of the Harappan Civilisation): এ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার যত কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায় বর্তমান ভারত ও পাকিস্থানের এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল । পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, গুজরাট, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম অংশের কিছু অঞ্চল জুড়ে এই সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল । এই সভ্যতা পশ্চিমে বালুচিস্তানের সুত্‌কাগেন্‌দর থেকে পূর্বে মিরাট জেলার আলমগির পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল (১৬০০ কিমি) । উত্তরে সিমলা পাহাড়ের নীচে রূপার থেকে দক্ষিণে গুজরাটের ভোগাবর পর্যন্ত এলাকা (১১০০ কিমি) এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ছিল । যেহেতু সিন্ধু নদের তীরবর্তী অঞ্চল ছাড়াও আরও বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাই সিন্ধু সভ্যতা নামটি বর্তমানে অনেকাংশে অপ্রাসঙ্গিক হয়েপড়েছে । তবুও সাধারণ ভাবে এই সভ্যতাকে এখনও আমরা সিন্ধু সভ্যতা বলেই অভিহিত করে থাকি ।

(২) সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা (Founder of the Harappan Civilisation): সিন্ধু সভ্যতা ভারতীয় সভ্যতা, না বিদেশিরা, অর্থাৎ, মেসোপটেমিয়ার জনগণ এই সভ্যতার সৃষ্টিকর্তা, তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। অন্যদিকে এই সভ্যতা আর্যসৃষ্ট না অনার্যসৃষ্ট, অর্থাৎ, দ্রাবিড়দের তৈরি, তা নিয়েও বিস্তর বিতর্ক আছে । ফাদার হেরাস ও অন্যান্য পন্ডিত সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা হিসাবে দ্রাবিড়দের পক্ষে যেমন কয়েকটি জোরালো যুক্তি দিয়েছেন, তেমনই দ্রাবিড়দের দাবির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ঐতিহাসিক যে যুক্তি দিয়েছেন, তাও কম জোরালো নয়। এই অবস্থায় দ্রাবিড়দের দাবির পক্ষে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় । তবে সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা হিসেবে আর্যদের দাবি খুবই দুর্বল বলে মনে হয় । সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সুমেরীয় বা মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বহু সাদৃশ্য আছে বলে অনেকে সুমেরীয়দের এই সভ্যতার সৃষ্টিকর্তা বলে মনে করেন। বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ মার্টিমার হুইলার উভয় সভ্যতার মধ্যে বহু বৈসাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করে সুমেরীয়দের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে, সিন্ধুগণ হয়তো সভ্যতার আদর্শ বা ধারণা সুমেরীয়দের কাছ থেকে ধার করেছিল । কিন্তু এই সভ্যতা আসলে ভারতীয়রাই তৈরি করেছিল । অধ্যাপক বাসামও হুইলারকেই সমর্থন করেছেন । বিষয়টি এখনও বিতর্ক স্তরে আছে । তাই এ সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভবপর হয়নি । তবে এই সভ্যতা ভারতীয়রাই সৃষ্টি করেছিল বলে মনে হয়।

(৩) সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা (Time Limit of the Harappan Civilisation): সিন্ধু সভ্যতা কবে শুরু হয়েছিল এবং কবে তার ধ্বংস হয়েছিল, এ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না । মার্শালের মতে, এই সভ্যতার স্থায়িত্বকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৫০ অব্দ থেকে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৭৫০ অব্দ । বর্তমানে মার্শালের এই মত অনেকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না । পিগো ও হুইলারের মতে, এই সভ্যতার পরিণত পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল  খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ । ডি.পি.অগ্রওয়াল, গ্যাড, অলব্রাইট প্রভৃতি পন্ডিতও মোটামুটি একই সিদ্ধান্তে এসেছে । ড. দিলীপকুমার চক্রবর্তী মনে করেন এই সভ্যতার সূত্রপাত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি এবং শেষ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয় ভাগে ।

(৪) সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ (Causes of Decline of the Harappan Civilisation): সিন্ধু সভ্যতা কেন ও কীভাবে ধ্বংশ হয়েছিল তা আমাদের কাছে অজ্ঞাত । সম্ভবত সর্বত্র একই সঙ্গে বা একই কারণে পতন ঘটেনি ।

(১) কারও মতে, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব মহেন-জো-দরো শহরের পতন ডেকে এনে ছিল ।
(২) অনেকের মতে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী । প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যা । মার্শাল, ম্যাকে, রেইক্স, ডেল্‌স প্রভৃতিরা মনে করেন বন্যাই এই সভ্যতার পতনের কারণ ।
(৩) অনেকে আবার মনে করেন বন্যা নয়, অনাবৃষ্টির জন্যই এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। বৃষ্টিপাতের তারতম্য ও জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদন বলে অনেকে মনে করেন ।
(৪) রেইক্স সহ কেউ কেউ নদীর গতিপথের পরিবর্তনের মধ্যে পতনের কারণ অনুসন্ধান করেছেন । এর ফলে মরুভূমির মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল ।
(৫) কেউ কেউ মনে করেন ভূমিকম্প এই সভ্যতার পতন ডেকে এনে ছিল ।
(৬) অনেকের মতে, বিদেশি শত্রুর আগমন এই সভ্যতার অন্যতম প্রধান কারণ । বিদেশি শত্রু বলতে অনেকেই আর্যদের চিহ্নিত করেছেন । এই মতের প্রবক্তা গর্ডন চাইল্ড ও ড.হুইলার । বর্তমানে অবশ্য এই বিষয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তন : সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতা Evolution of Indian Civilisation
►উদ্ভব ও বিবর্তন: আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস ও আর্য সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু উভয় সভ্যতার মধ্যে সম্পর্ক, কোনটি আগে, কোনটি পরে বা আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা কিনা, আর্যদের আদি বাসস্থান ভারতে, না তারা বহিরাগত— এইসব প্রশ্ন নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বাগবিতণ্ডার অন্ত নেই। এসব প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য কোনো উত্তর হয় না । বেদ ছিল আর্য মনীষার প্রধান ফসল এবং বেদ থেকেই আমরা আর্যসভ্যতার পরিচয় পাই। তাই এই সভ্যতাকে বৈদিক সভ্যতা বলা হয় । ঋক্‌বেদের সময় থেকেই ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। ঋক্‌বেদ কবে রচিত হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না । ম্যাক্সমুলারের মতে, এর রচনা কাল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে। বালগঙ্গাধর তিলকের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দ । দ্বিতীয় মতটি কেউই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না। যাই হোক, সাধারণভাবে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে ঋক্‌বেদ রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এই যুগকে তাই ঋক্‌বৈদিক যুগ বলা হয়। ঋক্‌বৈদিক যুগের পরবর্তী যুগকে পরবর্তী-বৈদিক যুগ বলা হয়।

বৈদিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য (Features of vedic civilization):
সাধারণভাবে খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রীস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত প্রায় ১০০০ বছরকে আমরা বৈদিক যুগ বলে থাকি। এই যুগের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়ে । প্রথমত,এই সময় থেকেই ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয় । অর্থাৎ এই সময় থেকেই আমরা সাহিত্যিক উপাদানের উপর নির্ভর করতে পারি । বেদ থেকে আমরা সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের বহু মূল্যবান তথ্য জানতে পারি । দ্বিতীয়ত, এই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস আমাদের কাছে অস্পষ্ট ও অনেকাংশে অজ্ঞাত । তৃতীয়ত, বৈদিক সাহিত্যের উৎকর্ষতা ও উন্নত মান যেকোনো দেশের গর্বের বস্তু । এই সময়ে এত উন্নত মানের সাহিত্য পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায়নি। চতুর্থত, বৈদিক সভ্যতাই উত্তর ভারতের গঙ্গা-যমুনা বিধৌত বিস্তীর্ণ সমভুমির প্রথম সভ্যতা । সিন্ধু সভ্যতার পূর্বতম সীমানা ছিল মিরাট জেলার আলমগিরপুর । পঞ্চমত, বৈদিক সভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। প্রথমে তারা যাযাবর জীবন যাপন করত । পশুপালন ছিল তাদের প্রধান উপজীবিকা । পরে তারা কৃষিকাজ শুরু করে ও গ্রাম গড়ে তোলে। পরিশেষে, মনে রাখা দরকার যে,আর্যরা যে উন্নত মানের সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল,তা যুগে যুগে ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং আজ আমরা সেই ঐতিহ্য ও পরম্পরার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি ।
ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তন : সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতা Evolution of Indian Civilisation
 

No comments:

Post a Comment

Please do not any spam in the comments Box.

Please Subscribe For My YouTube

গল্প কথা


আজকের শিশু আগামি দিনের ভবিস্যৎ.........









Contact Us

Name

Email *

Message *